আবু হাসান শাহরিয়ার
প্রিয় বাংলাদেশ, ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই। নদী ও গাছের সঙ্গে কথা বলতে চাই। পশু ও পাখির সঙ্গে কথা বলতে চাই। চর্যার হরিণীর সঙ্গে কথা বলতে চাই। বেগুনি রিবন-বাঁধা ভাঁটফুলের সঙ্গে কথা বলতে চাই। মাটি ও মানুষের সঙ্গে কথা বলতে চাই। পৃথিবীর সব বঞ্চিত মানুষের সঙ্গে কথা বলতে চাই। কবিকে কথা বলতে দাও।
কবিকে কথা বলতে না-দিলে শিশুর চয়নিকা থেকে মুছে যাবে বাঙলা বর্ণমালা। একুশের প্রথম প্রহরে আবারও রক্তবৃষ্টি হবে রাজপথে। কবিদের কথা বলতে দাও।
প্রিয় জন্মভূমি, কবিরা স্বার্থপর নয়। অর্বাচীন নয় শব্দের তাঁতিরা। কবি কথা বলবেন, কৃষক বলবেন না– তা কী করে হয়? কৃষককেও কথা বলতে দাও। কৃষকদের হয়ে নাচোলের ইলামিত্রও কথা বলবেন। তিনি কথা না-বললে সর্ষেমাখা-পায়ে তেভাগার স্বপ্ন কবিতায় উঠে আসবে কী করে? ঘোর অমাবস্যার রাতে আশার লণ্ঠন হাতে কে পৌঁছে দেবে বঞ্চিত মানুষকে তার স্বপ্নের ঠিকানায়?
প্রিয় মাতৃভূমি, কৃষক কথা বলবেন, ছাত্র বলবেন না– তা কী করে হয়? ছাত্রকেও কথা বলতে দাও। ছাত্রদের হয়ে শিক্ষকও কথা বলবেন। তা না-হলে জোহার মিছিল-কাঁধে হেঁটে-যাওয়া ঊনসত্তর মুছে যাবে ইতিহাস থেকে। জেলের তালা ভেঙে শেখ মুজিবও আর ফিরে আসবেন না তার স্বজাতির কাছে। মুক্তির কোনও যুদ্ধই হবে না কোনও শোষিত জনপদে। পরাধীন মানুষ চিরপরাধীনই থেকে যাবে।
প্রিয় স্বদেশ, কবিকে কথা বলতে না-দিলে তোমার বন্দনাময় জাতীয় সঙ্গীত মিথ্যে হয়ে যাবে। ঐ সঙ্গীত কবিরই রচনা। কে পারে কবির চেয়ে বেশি ভালবাসতে তার দেশকে? উত্তরে হিমালয় আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর সাক্ষী, চাঁদসদাগর আর তার হেঁতালের লাঠি সাক্ষী, যখনই তুমি বিপন্ন হয়েছ, চর্যার কবিরা ফিরে-ফিরে এসেছেন এই বাঙলায়। কবিকে কথা বলতে দাও। কবিদের কথা বলতে দাও।
কবিকে কথা বলতে না-দিলে দেশাত্মবোধক গান থেকে সব বাণী মুছে যাবে নিমেষেই; সুর ও ছন্দরা বোবা আর্তনাদ করবে। এবং কলরেডি মাইক থেকে কেবলই কর্কশ স্বরে ধ্বনিত হবে– হ্যালো ওয়ান টু থ্রি মাইক্রোফোন টেস্টিং… হ্যালো হ্যালো… হ্যালো মাইনাস টেস্টিং… হ্যালো হ্যালো… হ্যালো মাইনাস ওয়ান টু থ্রি… হ্যালো মাইনাস ১৫ কোটি… হ্যালো হ্যালো…