যুগের কথা প্রতিবেদক : ২০২১ সালেই প্রথম বারের মতো ২৫ জুলাই (রোববার) আন্তর্জাতিকভাবে ‘পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ’ দিবস পালিত হয়। অথচ সিরাজগঞ্জে ২০২১ সালের বিভিন্ন পত্র পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, জানা যায়, গত জানুয়ারি ২০২১ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ বছরে পানিতে ডুবে ৩৩ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে শুধু উল্লাপাড়া উপজেলার সলঙ্গা থানায় মারা গেছে ৯ জন।
অভিভাবকদের সচেতনতার অভাব এবং সাঁতার না জানাই এই মৃত্যুর প্রধান কারণ। তবে পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যুকে ‘নীরব মহামারি’ অভিহিত করে বেসরকারি পর্যায় থেকে দীর্ঘদিন ধরে জনসচেতনতা, সরকারি নীতি প্রণয়নের দাবি জানালেও কার্যত দেশে সে রকম কোনো উদ্যোগ নেই।
শিশু ও বিভিন্ন দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের গবেষকেরা বলছেন, দেশে সবার ধারণা নিউমোনিয়া, ডায়রিয়ায় শিশুর মৃত্যু বেশি হয়। কিন্তু আসলে বেশি শিশু মারা যায় পানিতে ডুবেই। “যা সড়ক দুর্ঘটনার মতো এতো বেশি চোখে পড়েনা। সে কারণে আলোচনাতেও আসেনা।”
গত ২০২১ সালে পানিতে ডুবে ৩৩ শিশুর মৃত্যু মধ্যে- সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা : গত ১৭ জানুয়ারি বেলা পৌনে ৩টার দিকে সদর উপজেলার সয়দাবাদ ইউনিয়নের জারিলা পোড়াবাড়ি গ্রামের একটি পুকুর থেকে অজ্ঞাতপরিচয় এক বৃদ্ধের (৬০)মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। (৭ মে) নানীর সঙ্গে গোসল করতে গিয়ে ইব্রাহিম হোসেন (৭) নামে একটি শিশু যমুনা নদীতে ডুবে মারা গেছে। ৯ ডিসেম্বর পৌর এলাকায় পুকুরের পানিতে ডুবে শহীদ আলী নামে ১৮ মাস বয়সী এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
উল্লাপাড়া উপজেলা – ০৫ মার্চ সলঙ্গায় ফুলজোড় নদীতে ডুবে অনন্য (৭) নামে একটি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার (২ এপ্রিল) পুকুরের পানিতে ডুবে মোস্তাকিন নামে দেড় বছর বয়সী এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। সলঙ্গা থানাধীন হাটিকুমরুল ইউনিয়নে ডোবার পানিতে ডুবে তাসকিয়া খাতুন (১৪) নামে একটি শিশুর (১০ মে) বিকেলে সলঙ্গায় পৃথক স্থানে পানিতে ডুবে জিহাদ (৫) ও নোমান (৪) নামের দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। (২০ মে) বিকেলে সলঙ্গায় পুকুরের পানিতে ডুবে তানজীদ (৪) এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। (২৭ জুলাই) মঙ্গলবার বর্ষার পানিতে গোসল করতে নেমে রাইয়ান (১৬) নামে এক এসএসসি পরীক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। ২৩ অক্টোবর রাতে উপজেলার চার সাতবাড়িয়া এলাকার ফুলজোর নদী থেকে অজ্ঞাতপরিচয় (৪২) এক যুবকের মাথাবিহীন মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ২৬ অক্টোবর উপজেলার সলঙ্গা-ঘুড়কা আঞ্চলিক সড়কের বাসুদেবকোল ভুরভুরিয়া বিল এলাকায় মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পুকুরে পড়ে গেলে পানিতে ডুবে সৈয়দ বনিউল আলম বিপু (৩৫) নামে এক স্থানীয় সাংবাদিকের মৃত্যু হয়েছে। সে স্থানীয় সাপ্তাহিক দুর্জয় বাংলাদেশ পত্রিকার ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
কাজিপুর উপজেলা- ১৯ মার্চ হাটশিলা গ্রামের পানিতে ডুবে জান্নাতুল মাওয়া (০৪) নামে একটি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। ২৫ মার্চ পানিতে ডুবে সুমাইয়া খাতুন (১০) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। ৩ জুলাই দুপুরে বাড়ির পাশের পুকুরে পানিতে ডুবে সাদিয়া আক্তার (৮) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
তাড়াশ উপজেলা- ৩০ মার্চ বাড়ির পাশের পুকুরে পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু। মৃত শিশুরা হলো- ওই গ্রামের শাহজাহান আলীর মেয়ে জান্নাতি খাতুন (১০) ও বাচ্চু মিয়ার মেয়ে ইতি খাতুন (১৩)। জান্নাতী ভায়াট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী ও ইতি ভায়াট ভিএস উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী ছিল। ২৬ এপ্রিল পানিতে ডুবে শাহাদৎ হোসেন (৪০) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। ৫ নভেম্বর বিকেলে উপজেলার সগুনা ইউনিয়নের ধামাইচ ঈশ্বরপুর গ্রামের পুকুরের পানিতে ডুবে ইসরাফিল হোসেন (৪) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। ইসরাফিল ওই ইউনিয়নের বিনসাড়া গ্রামের মো. আল-আমিনের ছেলে। ২৬ এপ্রিল সকালে উপজেলার মাধাইনগর ইউনিয়নের ওয়াশিন উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশের পুকুরে ডুবে শাহাদৎ হোসেন (৪০) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে।
রায়গঞ্জ উপজেলা – ২৩ এপ্রিল উপজেলার পাঙ্গাসী ইউনিয়নে নাড়ুয়া গ্রামে পুকুরে গোসল করতে নেমে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। মৃত শিশুরা হলো- নাড়ুয়া গ্রামের মো. সেলিম হোসেনের ছেলে হামজেলা (৫) ও আব্দুল হাশেমের মেয়ে আয়েশা মনি (৪)। এছাড়া ২৬ জুলাই বিলচন্ডী গ্রামে পুকুরের পানিতে ডুবে স্কুল ছাত্রী মোছাঃ রুবাইয়া খাতুন (১১) মৃত্যু হয়েছে।
চৌহালী উপজেলা – ৯ সেপ্টেম্বর উপজেলার এনায়তেপুর স্পার বাঁধ এলাকায় যমুনা নদীতে নৌকা থেকে পড়ে ৫ জন নিখোঁজ হন। নিখোঁজরা হলেন- জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের খুরমা গ্রামের তোতা মিয়ার ছেলে জাহিদ হোসেন (৮), ওমর আলীর স্ত্রী সুফি বেগম (৫০), মিন্টু হোসেনের স্ত্রী হেলেনা খাতুন (৩০) এবং আব্দুস সাত্তার (৬০) নামে এক ব্যক্তি এবং তানিয়া (৪) নামে একটি শিশুর মরদেহ উদ্ধার করা হয় । ২৯ জুলাই বিকেলের দিকে উপজেলার এনায়েতপুর স্পারবাঁধ এলাকায় যমুনা নদীতে গোসল করতে নেমে রেজাউল করিম (২২) নামে এক যুবক নিখোঁজ হন। রেজাউল পাবনার ঈশ্বরদী পৌরসভা এলাকার আলহাজ্ব মোড়ের আবুল কাশেমের ছেলে।
কামারখন্দ উপজেলা – উপজেলার (১৮ জুলাই) রবিবার ঝাঐল ইউনিয়নের চাঁদপুর গ্রামে পুকুরের পানিতে ডুবে মোহাম্মদ আলী (২) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। ২৭ সেপ্টেম্বর দুপুরে উপজেলার কর্ণসূতি গ্রামে কলা গাছের ভেলায় চড়ে খেলতে গিয়ে খালের পানিতে ডুবে জান্নাতুল খাতুন (০৫) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। সে ওই গ্রামের নুরুল ইসলামের মেয়ে।
বেলকুচি উপজেলা – ২৩ অক্টোবর বিকেলে উপজেলার ক্ষিদ্রমাটিয়া গ্রামে যমুনা নদীর শাখায় গোসল করতে নেমে নিখোঁজ হওয়া স্কুলছাত্র নাঈমের (১২) মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। চন্দনগাঁতী গ্রামের নূরনবীর ছেলে। সে সোহাগপুর এস কে পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল।
শাহজাদপুর উপজেলা – ৩০ জুলাই সন্ধ্যায় উপজেলার পোতাজিয়া ইউনিয়নের রাউতরা রিং বাঁধ এলাকা থেকে ফাহিম হোসেন অনিক (২২) নামের নিখোঁজ এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। সে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং পাবনার সাঁথিয়া উপজেলা এলজিইডির প্রকৌশলী আকরাম হোসেনের ছেলে। তাদের বাড়ি সাঁথিয়ার সোনাতলা গ্রামে ।
পানিতে ডুবে মৃত্যু বিষয়ে ২০১৪ সালে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক। ‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন ড্রনিং’ শিরোনামে বিশ্ব প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা বিশ্বে প্রতিবছর ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৪০০ জন পানিতে ডুবে মারা যায়। তাদের ২০ শতাংশের বয়স ৫ বছরের কম। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর হারে বাংলাদেশ বিশ্বে অন্যতম। সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশে ১ থেকে ৪ বছর বয়সী শিশুদের মোট মৃত্যুর ৪৩ শতাংশ হয়েছে পানিতে ডুবে। সংস্থাটি বলেডয়ল, “শিশুদের ক্ষেত্রে ০-১৭ বছর বয়সীরা ডুবেই মারা যায় বেশি। প্রতি বছর ১৪ হাজারের মতো শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। অর্থাৎ গড়ে প্রতি দিন ৪০ জন শিশু প্রাণ হারাচ্ছে পানিতে ডুবে।”
আগে বর্ষা মৌসুমে পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা বেশি হলেও এখন সারা বছরই এই মৃত্যুর শিকার হচ্ছে শিশুরা। সকাল নয়টা থেকে বেলা দুইটার মধ্যেই সাধারণত পানিতে ডুবে মৃত্যু ঘটনা বেশি ঘটে। এ সময় মায়েরা সাংসারিক নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন। বাবারা কাজের জন্য বাড়ির বাইরে যান। এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ওই অঞ্চলে প্রলম্বিত বন্যা ও জলাবদ্ধতার কারণেই এতো পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশে পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার কমছে না। বাংলাদেশে ২০২০-২০২১ সালে ১৯ মাসে ১,হাজার ৫শ ১২ জন পানিতে ডুবে মারা গেছেন বলে গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটর নামে একটি এনজিওর এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে।