যুগের কথা ডেস্ক:
সাম্প্রতিক কালে সামাজিক মাধ্যমের দৌলতে পান্তা ভাতকে বড় রেস্তরাঁর মেনুতে দেখে খানিক অবাকই লাগে। সমাজের নীচের তলার খাবার, উপরের তলার মানুষের পাতে এ ভাবে দেখতে পাওয়াটা খাদ্যের ইতিহাসে এক নতুন সংযোজন।
২০২১ সালে মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়ার মঞ্চে কিশোয়ার চৌধুরীকে পান্তা ভাত আর আলুর ভর্তা রান্না করতে দেখে মন গলেনি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এক বাঙালিনীকে ওই মঞ্চে দেখার আনন্দ সে দিন ছাপিয়ে গিয়েছিল পান্তার মতো এক অতি সাধারণ কিন্তু আদ্যোপান্ত বাঙালি খাবারকে ওই মঞ্চে দেখতে পাওয়ার গর্ব। কোথাও গিয়ে আশা জেগেছিল, যে বিশ্বের দরবারে বাঙালি খাবারের জয়যাত্রার হয়তো বা এখানেই শুরু।
ইতিহাসে পাওয়া না গেলেও সকলেই জানেন, যবে থেকে মানুষ রান্না করে ভাত খাওয়া শিখেছে, সে দিন থেকেই বাড়তি ভাত সংরক্ষণের জন্য তাতে জল ঢেলে পান্তা করার প্রচলন। আর এই ভিজিয়ে রাখা ভাত নানা রূপে নানা ভাবে খুঁজে পাওয়া যায় পৃথিবীর সেই সব দেশগুলিতে যেখানে ভাত মানুষের প্রধান খাদ্য। আপাত দৃষ্টিতে এই অতি সাধারণ খাবারটি বেশির ভাগ দেশেই প্রান্তজনের খাবার।
হ্যাঁ খাদ্যের সঙ্গে মানুষের পদমর্যাদা আর শ্রেণীচরিত্রের সম্পর্ক যেমন নতুন কিছু নয়, তেমনই বাংলার প্রধান খাদ্য ভাতও এই শ্রেণীকরণের বাইরে নয়। সরু চালের সুগন্ধি ভাত আর তার বিবিধ পদ অভিজাতদের জন্য আর লাল মোটা চাল আর পান্তা গরিব মানুষের ভাগে— এ হিসেবে বহু পুরনো। তাই সাম্প্রতিক কালে সামাজিক মাধ্যমের দৌলতে পান্তা ভাতকে বড় রেস্তরাঁর মেনুতে দেখে খানিক অবাকই লাগে। সমাজের নীচের তলার খাবার, উপরের তলার মানুষের পাতে এ ভাবে দেখতে পাওয়াটা খাদ্যের ইতিহাসে এক নতুন সংযোজন।
এ নিয়ে আবার নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেন, প্রান্তজনের খাবারকে এ ভাবে গৌরবান্বিত করলে মানুষের দুঃখ-কষ্টের ইতিহাসকে অপমান করা হয়। কেউ আবার বলেন, চাষিকে তার উপযুক্ত প্রাপ্য না দিতে পারলে পান্তা ভাত নিয়ে এই উচ্ছ্বাস, উপহাসেরই নামান্তর।
কিন্তু আমার মতো যাঁরা খাবারদাবারের মাধ্যমে খুঁজে পেতে চান মানুষের জীবনযাপনের ইতিহাস আর ঐতিহ্য, তাঁদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে অতি সাধারণ এই খাবার ঘিরে ইতিহাসে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার কোলাজ। শুরু করা যাক একটি মজার ঘটনা দিয়ে।
সময়টা ১৭৫৬ সালের এপ্রিল মাস, নবাব আলীবর্দী খানের সদ্য মৃত্যুর পর তাঁর পৌত্র সিরাজদ্দৌলা জাঁকিয়ে বসেছেন মুর্শিদাবাদের দরবারে। প্রথম থেকেই সিরাজ ছিলেন ইউরোপ বিরোধী আর বাংলা তথা ভারতের বুকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাড়তে থাকা রাজনৈতিক ও সামরিক প্রভাব দেখে বিরক্ত হয়ে শীঘ্রই মুর্শিদাবাদে বন্দি করেন হেস্টিংস সহ বেশ কিছু ব্যবসায়ীকে। কিছু দিন নবাবের মধ্যস্থতাকারি হিসেবে কাজ করার পরে এক পূর্ব পরিচিত বাঙালি ব্যবসায়ী কৃষ্ণকান্ত নন্দীর সাহায্যে, হেস্টিংস মুর্শিদাবাদ থেকে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেন তার বাড়িতে। কান্তবাবু নামে পরিচিত কৃষ্ণকান্তের বাড়িতে হেস্টিংসের মতো সাহেবকে খেতে দেওয়ার মতো সে দিন কিছুই ছিল না। কথিত আছে, বাংলার আইঢাই গরমে তিনি ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত হেস্টিংসকে কলাপাতায় পান্তা, ভাজা চিংড়ি এবং কাঁচা পেঁয়াজ খাইয়ে সাহেবের প্রাণরক্ষা করেছিলেন।
পরবর্তীকালে এই ঘটনাটি একটি মজার ছড়ায় রূপান্তরিত হয়।
‘হেষ্টিংস্ সিরাজ ভয়ে হয়ে মহাভীত,
কাশিমবাজারে গিয়া হন উপনীত |
কোন স্থানে গিয়া আজ লইব আশ্রয়,
হেষ্টিংসের মনে এই নিদারুণ ভয় |
কান্ত মুদি ছিল তাঁর পূর্ব্বে পরিচিত,
তাঁহারি দোকানে গিয়া হন উপস্থিত |
নবাবের ভয়ে কান্ত নিজের ভবনে
সাহেবকে রেখে দেয় পরম গোপনে |
সিরাজের লোকে তাঁর করিল সন্ধান,
দেখিতে না পেয়ে শেষে করিল প্রস্থান |
মুসকিলে পড়িয়ে কান্ত করে হায় হায়,
হেষ্টিংসে কি খেতে দিয়া প্রাণ রাখা যায়?
ঘরে ছিল পান্তাভাত, আর চিংড়ি মাছ
কাঁচা লঙ্কা, বড়ি পোড়া, কাছে কলাগাছ |
কাটিয়া আনিল শীঘ্র কান্ত কলাপাত,
বিরাজ করিল তাহে পচা পান্তা ভাত |
পেটের জ্বালায় হায় হেষ্টিংস তখন
চব্য চুষ্য লেহ্য পেয় করেন ভোজন |
সূর্য্যোদয় হল আজ পশ্চিম গগনে,
হেষ্টিংস ডিনার খান কান্তের ভবনে |’