ইসমাইল হোসেন, নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক সিরাজগঞ্জ প্রতিদিন: বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষি কর্মকান্ডের উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের শতকরা ৭৬ ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে এবং গ্রামের মানুষের শতকরা ৯০ ভাগ সরাসরি কৃষির উপর নির্ভরশীল। দেশের জিডিপি’তে কৃষির অবদান প্রায় ১২% যেখানে দেশের প্রায় ৪৪% শ্রমশক্তি নিয়োজিত আছে বিধায় কৃষিই হচ্ছে বালাদেশের মাুনষের আয় ও কর্মসংস্থানের মূল উৎস। কৃষির উপরই বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্ভরশীল। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলির মধ্যে অন্যতম হিসাবে বিবেচিত। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপদাপন্নতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেশের জল-ভূতাত্তিক ও আর্থ-সামাজিক অবস্থানের কারনে সৃষ্ট। জলবায়ু পরিবর্তনের এই প্রভাব দেশের বেশকিছু ক্ষেত্রে পরিবেশের উপরও পড়ে। এবং এর বেশি প্রভাব কৃষির উপরই বিদ্যমান।
দেশের অন্যতম বৃহত্তম নদী, যমুনার তীরে সিরাজগঞ্জ অবস্থিত হওয়ায় বাংলাদেশের ব্যাপক বন্যা প্রবণ জেলাগুলোর মধ্যে এই জেলা অন্যতম। জেলার মোট ৯ টি উপজেলার মধ্যে ৫ টি উপজেলা ব্যাপক বন্যা প্রবণ। বন্যা ও নদী ভাঙ্গন দ্বারা প্রভাবিত যা বৃষ্টিপাতের অনিশ্চয়তার উপর নির্ভরশীল। অতএব এই এলাকা জলবায়ু পরিবর্তন সংবেদনশীল, যার সর্বশেষ এবং সর্ববৃহৎ প্রভাব কৃষির উপরে পড়ে ।
সারা দেশের ন্যায় সিরাজগঞ্জ জেলাও ক্রান্তীয় মৌসুমী বায়ূ দ্বারা প্রভাবিত। ছয়টি আবহাওয়া ঋতুর মধ্যে এই জেলায় তিনটি কৃষি ঋতু স্পষ্টভাবে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। বৃষ্টিপাত এই এলাকার পানির প্রধান উৎস। মার্চ এবং এপ্রিল মাস শুস্ক মৌসুম। এ সময় তাপমাত্রা খুব বেশি থাকে এবং আর্দ্রতা থাকে কম। এ সময় মাঝে মাঝে কাল বৈশাখি ঝড় হয়। মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বর্ষা বিরাজ করে এবং বার্ষিক বৃষ্টিপাতের ৯০ শতাংশ সাধারণত এই সময়ের মধ্যে হয়ে থাকে। বছরের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত সাধারণত মে থেকে সেপ্টেম্বর মাসে হয়ে থাকে এবং সর্বোচ্চ আর্দ্রতা থাকে জুলাই মাসে। শীত সাধারণত নভেম্বর মাসে শুরু হয় এবং শেষ হয় ফেব্রুয়ারি মাসে। এ সময় খুব ঠান্ডা থাকে, বৃষ্টিপাত সাধারণত হয় না, হলেও খুব কম হয়ে থাকে। এলাকায় সর্বনি¤œ তাপমাত্রা সাধারণত ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসে অনুভূত হয়। সিরাজগঞ্জ এলাকায় সর্বনি¤œ তাপমাত্রা অনুভূত হয় ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসে, যা কখনও কখনও ৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হয়ে থাকে। অন্যদিকে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২/৪৩ ডিগ্রি যা অনুভূত হয়ে থাকে এপ্রিল-মে মাসে।
সিরাজগঞ্জে বিভিন্ন জাতের ফসল উৎপন্ন হলেও উৎপাদন ও দেশের প্রধান খাদ্য হিসাবে গুরুত্বের দিক থেকে আবশ্যিকভাবে ধান এই জেলার অত্যন্ত প্রাধান্য বিস্তারকারী ফসল। জেলার শতকরা ৭০ ভাগেরও বেশি কৃষি জমিতে ধান উৎপন্ন হয়। অন্যান্য উৎপাদিত ফসলের মধ্যে গম, পাট, আলু, কলাই, আখ, মরিচ, তৈল বীজ (সরিষা, তিল, তিসি) চীনাবাদাম, সবজি ইত্যাদি উল্ল্যেখযোগ্য। বিভিন্ন উপাদান যেগুলি এই এলাকার কৃষিকে নিয়ন্ত্রণ করে তথা কৃষি উৎপাদনের উপর প্রভাব বিস্তার করে তা হলো ফলন মৌসুম, খরা বা উচ্চ তাপমাত্রা, সম্ভাব্য বাস্পীভবন, ভারী বৃষ্টিপাত, বন্যা, শৈত প্রবাহ ইত্যাদি। এসব বিবেচনায় সিরাজগঞ্জ জেলায় তিনটি কৃষি মৌসুম রয়েছে যেমন: রবি মৌসুম- অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, খরিফ-১ মৌসুম- মার্চ থেকে জুন এবং খরিফ-২ মৌসুম- জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর; মাঝে, মাঝারী উঁচু ও নিচু জমিতে সেচের সাহায্যে বোরো ধান চাষ করা হয়। তৈল বীজ (সরিষা) ফসল, ডাল বীজ (মাসকলাই) ফসল, গম, চীনাবাদাম, আলু, সবজি মূলত রবি মৌসুমে চাষ হয়ে থাকে। বোরো ধান, পাট, আউশ ধান, খেসাড়ী, কিছু কিছু তৈল বীজ ফসল খরিফ মৌসুমের ফসল।
সিরাজগঞ্জ জেলা এলাকার জলবায়ু পরিবর্তন প্রবণতা বেশ বৈচিত্রপূর্ণ। জেলার কোথাও কোথাও কখনও কখনও দিনের বেলা খুব গরম থাকে এবং রাতের বেলা ঠান্ডা থাকে। বৃষ্টিপাতের বিষয়টাও কখনও কখনও অত্যাধিক হয় কখনও অনাবৃষ্টি বা খরা থাকে। এলাকায় রবি মৌসুমে বৃষ্টিপাতের পরিমান খুবই কম থাকে কখনও কখনও যা সর্বনি¤œ পর্যায়ে নেমে আসে, তীব্র খরা অনুভূত হয়। কখনও কখনও খরা প্রবণতার পর বৃষ্টিপাতের পরিমান বৃদ্ধি পেয়ে অতিবৃষ্টিতে রুপান্তরিত হয়। রবি মৌসুমে গড় তাপমাত্রা অক্টোবর-নভেম্বর মাসে স্থিতিশীল থাকলেও পরের মৌসুমে তা কমতে থাকে। অন্যদিকে রবি মৌসুমে সর্বোচ্চ তাপমাতা প্রায়ই স্থির থাকে। খরিপ মৌসুমের গড় সর্বনি¤œ তাপমাত্রা সময়ভেদে পরিবর্তিত হলেও গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা স্থির থাকে। সিরাজগঞ্জ জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে বিগত বছর গুলিতে বন্যা স্তরে নি¤œ পানিস্তর ও উচ্চ পানিস্তর দুই ক্ষেত্রেই ক্রমবর্ধমান উর্দ্ধমুখী প্রবণতা পাওয়া যায়। বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে বিগত ৪০ বছরের (১৯৮০-২০২০) খরা পবণতা, তার পূর্বের ৩০ (১৯৫১-১৯৮০) বছরের খরা প্রবণতার চেয়ে ক্রমবর্ধমান উর্দ্ধমুখী প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। জেলার বিভিন্ন স্থান ভেদে খরা প্রবণ এলাকায় কৃষি, জলবায়ু পরিবর্তনে খরার প্রবণতা সাধারণভাবে লক্ষ্যনীয়।
পানি অন্যতম একটি জলবায়ূ উপাদান- যা ফসলে মাটির পুষ্টি প্রাপ্যতা নিয়ন্ত্রণ করে এবং ফসলের দৈহিক গঠন ও বিস্তারকে প্রভাবিত করে এবং এটি ফসলের বৃদ্ধি ও বিকাশের ক্ষেত্রে খুবই প্রয়োজন হয় এবং সঙ্কটকালীন সময়ে পানি ন্যুনতম স্তরে না থাকলে ফসল বাঁচতে পারে না। অন্যদিকে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারনে বন্যা বা জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় যা ফসলের ক্ষতির কারণ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ফসলের বেড়ে উঠার সময়ে বৃষ্টিপাতের তারতম্য এর উৎপাদনশীলতাকে প্রভাবিত করে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে বৃষ্টিপাতের পরিমানের তারতম্য বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন ফসলে উপর প্রভাব বিস্তার করে থকে। মৌসুমী বৃষ্টিপাতের পরিমান এবং বর্ষার মৌসুমে বৃষ্টিপাতের দিনের সংখ্যা এমনকি শীত কিংবা অন্য কোন শুস্ক মৌসুমে বৃষ্টিপাতের তারতম্যের পরিমানও ফসলের উৎপাদশীলতাকে প্রভাবিত করে থাকে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের তুলনায় বিলম্বে এমনকি আগাম বৃষ্টিপাত বীজের অঙ্কুরোদগম কমিয়ে দেয়। যার ফলে কৃষককে একাধিকবার বা অতিরিক্ত বীজ বপন করতে হয়। আবার এমনও জানা গেছে যে দীর্ঘ শুস্ক মৌসুম বা খরা প্রবণতার কারনেও ফসল উৎপাদন মারাত্মকভাবে কমে যায়। তবে শীতকালে বৃষ্টিপাতের পরিমানের তারতম্যের কারনে রবি শস্য যেমন আলু, সবজি, বাদাম ইত্যাদি উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্থ না হয়ে বরং বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় কিংবা উৎপাদন প্রায় একই রকম থাকে। সেচ নির্ভরশীলতার কারনে বৃষ্টিপাতের তারতম্যের প্রভাবে ধান উৎপাদন হার উঠানামা করে কিন্তু গম বা ডাল বীজ ফসল উৎপাদন কমে যায়। মৌসুমে বৃষ্টিপাতের পরিমানের তারতম্যের কারনে ধান, সরিষা ও গম উৎপাদন হার উঠানামা করলেও অনেক সময় দেখা গেছে মসলা ফসল, ডাল ফসল এবং বাদামের ক্ষেত্রে উৎপাদন সাধারণত বৃদ্ধি পায়। খরিপ মৌসুমে রোপা আমনে উৎপাদন প্রায় একই রকম থাকলেও বৃষ্টিপাতের পরিমানের তারতম্যের কারনে সবজি উৎপাদন হার উঠানামা করে।
এই সাইটে নিজম্ব নিউজ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন নিউজ সাইট থেকে খবর সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ প্রকাশ করে থাকি। তাই কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।