গোলাম মোস্তফা রুবেল : বিচার না পেয়ে দুর্ভোগে ক্লান্ত জিল হোসেন অবশেষে মৃত্যুর কাছে হেরে গেলেন। শিক্ষা জীবনের সনদ নিয়ে চ্যালেঞ্জ করে আদালতের রায়ে জিতলেও অর্জিত ফল ভোগ করতে পারলেননা তিনি। শিক্ষাসনদের দাবিতে সিরাজগঞ্জের জিল হোসেন যখন আদালতে মামলা করেন, তখন তিনি ২৩ বছরের টগবগে যুবক। চূড়ান্ত রায় না পেলেও আদালতের বারান্দায় ঘুরতে ঘুরতে তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন জীবন সায়াহ্নে। তার বয়স শেষ মুহুর্তে ছিলো ৭২-মৃত্যু তাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেলো। দুবার স্ট্রোক করে বাকশক্তিও হারিয়েছিলেন। জিল হোসেন যে সনদের জন্য আইনি লড়াই শুরু করেছিলেন, সেই সনদ হাতে পান ৪৭ বছর বয়সে। তখন চাকরিতে ঢোকার সব সুযোগ শেষ। জিল হোসেনের ক্লাসমেটরা সবাই যখন বড় বড় পদে চাকরি করেন, তিনি তখন মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। জীবনের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, তা আর পোষাবার মতো নয়। যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভুলে জিলের জীবন বিপন্ন করেছে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের মামলাও করেছিলেন। এ মামলায় নিম্ন আদালত থেকে ২০০৮ সালে ২ কোটি ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের রায় পান।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়টির করা আপিল ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত হাইকোর্টে বিচারাধীন। এক যুগ পেরিয়ে গেলেও আপিলের শুনানিই শুরু হয়নি।
প্রতিবেদক জিল হোসেনের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে গেলে অনেক কষ্টে ভাঙা ভাঙা গলায় অস্পষ্টভাবে তার স্ত্রী নুরনাহার বেগম বলেন, ‘আমার স্বামীর সঙ্গে অবিচার করা হয়েছে। বিগত ৪৯ বছরেও বিচার পেলো না সে।
তিনি আরো বলেন এবং অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৭১-৭২ শিক্ষাবর্ষে জিল হোসেন ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকের (কৃষি) পরীক্ষার্থী ছিলেন। এই পরীক্ষা হয় ১৯৭৩ সালে। ভুল করে মাত্র দশমিক ৫ মার্ক যুক্ত না করায় অকৃতকার্য হন। এই ফল পুনর্বিবেচনা চেয়ে একাডেমিক কাউন্সিলে আবেদন করেন; কিন্তু সেই আবেদনে কাজ হয়নি। পরে প্রতিকার চেয়ে ১৯৭৫ সালের ২২ এপ্রিল ময়মনসিংহের প্রথম মুনসেফ আদালতে মামলা করেন। মামলায় অভিযোগ আনেন- ১৯৭৩ সালে দেওয়া পরীক্ষায় তার প্রাপ্ত নম্বরের সঙ্গে ভগ্নাংশ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নম্বরের সঙ্গে ভগ্নাংশ যোগ না করে তাকে অকৃতকার্য ঘোষণা করে। এই মামলায় আদালত ১৯৭৫ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত এবং ভগ্নাংশ নম্বর যোগ না করে তাকে অকৃতকার্য করানোকে বেআইনি ঘোষণা করেন। এখানেই আমার স্বামী জিল হোসেনের মামলার পরিসমাপ্তি টানা যেত; দুর্ভাগ্য ছিলো তার।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তা না করে ওই রায়ের বিরুদ্ধে প্রথমে জজ আদালতে এবং পরে হাইকোর্টে আপিল করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট পুনর্বিচারের জন্য ময়মনসিংহের প্রথম মুনসেফ আদালতে পাঠান। এবার ১৯৭৮ সালের ২৪ জানুয়ারি মুনসেফ আদালত ভগ্নাংশ নম্বর যোগ করে ৩০ দিনের মধ্যে জিল হোসেনের পরীক্ষার ফল প্রকাশের নির্দেশ দেন; কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সে রায়ও মানেনি। আবার প্রথমে জেলা জজ আদালতে এবং পরে হাইকোর্টে আপিল করে। এবার হাইকোর্ট ১৯৮৩ সালের ১৬ জানুয়ারি ফল প্রকাশে বিচারিক আদালতের সিদ্ধান্ত বহাল রাখেন।
জিল হোসেন রায় তুলে ধরে ১৯৮৬ সালে আবেদন করলে বিশ্ববিদ্যালয় তাকে পাস মার্ক দিয়ে সার্টিফিকেট দেয় ১৯৯৭ সালের ২২ অক্টোবর। এ পর্যায়ে ২০০০ সালের ১৮ অক্টোবর ক্ষতিপূরণ দাবি করে মামলা করেন। তিনি অভিযোগ করেন, হাইকোর্টের রায় ১৪ বছর ৯ মাস পর কার্যকর করে বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন কাজে তার জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে। ক্ষতিপূরণ মামলায় ২০০৮ সালের ২৬ অক্টোবর রায় দেন ময়মনসিংহের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালত। রায়ে ৩০ দিনের মধ্যে ২ কোটি ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এর বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে হাইকোর্টে ফাস্ট আপিল করে বিশ্ববিদ্যালয়।
সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে ঢুকে দেখা যায়, এই আপিল (১২৮/২০০৯) মামলাটি শুনানির জন্য এ পর্যন্ত ১৭৪ বার আদালতের কার্যতালিকায় এসেছে। আপিল মামলাটি সর্বশেষ ২০২০ সালের ১২ মার্চ বিচারপতি মামনুন রহমানের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানির জন্য ছিল; কিন্তু করোনার কারণে থেমে যায় সব। আদালতের কার্যক্রম সচল হওয়ার পর ওই বেঞ্চের এখতিয়ারে পরিবর্তন এসেছে। নতুন বেঞ্চে আবার উত্থাপন করা হয়েছে বলে জানান জিল হোসেনের আইনজীবী। এখন মামলাটির শুনানি শুরু করতেই ছয় মাস থেকে এক বছর লেগে যেতে পারে। ততদিন জিল হোসেন বেঁচে থাকতে পারলেন না। গত ২১ ফেব্রুয়ারী সোমবার দুপুরে বগুড়া একটি হাসপাতালে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু বরন করেন।
এ মামলা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমীর-উল-ইসলাম জিলের দুবার স্ট্রোক করার ঘটনা তিনিও জানেন। বলেন, ‘এটা অনেক পুরনো মামলা। বারবার কোর্টের এখতিয়ার পরিবর্তন হওয়ায় শুনানি হয়নি।’ এখন তিনি মারা গেছেন আপনার কাছে শুনলাম।
জিল হোসেনের অসুস্থতার কারণে মামলাটি দেখভাল করেন তার ছোট ছেলে কিরণ খন্দকার। মামলার পেছনে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত কিরণ বাবার কবরের পাশে দারিয়ে বলেন, ‘মামলা চালাতে গিয়ে জমিজমা যা ছিল, প্রায় সবই বিক্রি করেছেন বাবা। ১৯৯৭ সালে মার্কশিট পাওয়ার পর বাবা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী ২৫ হাজার টাকা অনুদান দেন। এর সঙ্গে আরও ৩৫ হাজার টাকা সংগ্রহ করে ক্ষতিপূরণের মামলাটি করেন; কিন্তু হাইকোর্টে মামলা চালানোর মতো আর সামর্থ্য ছিল না। যে কারণে দারস্থ হই সুপ্রিমকোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটির কাছে। কমিটি ২০১৮ সালে বিনা ফিতে মামলা পরিচালনার জন্য একজন আইনজীবী দেন।’ কিরণ খন্দকারের এখন একটাই আর্জি- প্রধান বিচারপতি যেন মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির বিশেষ উদ্যোগ নেন। কিন্তু আজও নিস্পত্তি হলোনা তার আগেই বাবা নিজেই নিস্পত্তি হয়ে গেলেন।
কিরণের আইনজীবী চঞ্চল কুমার বিশ্বাস বলেন, এ ধরনের ফাস্ট আপিলের ক্ষেত্রে আপিলকারীপক্ষকে আগে শুনানি শুরু করতে হয়; কিন্তু শুনানির জন্য উঠলে আপিলকারীপক্ষ বারবার সময় নেন, অথবা অনুপস্থিত থাকেন। আপিল করার পর ১২ বছর চলে গেলেও তাদের অসহযোগিতার কারণে শুনানি হয়নি।
মামলা পরিচালনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষেরও লাখ লাখ টাকা ব্যয় হচ্ছে। দফায় দফায় হেরে যাওয়ার পরও আইনি লড়াইয়ে তারা এখনো অনড়। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়টির ভিসি অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসান স্বীকার করেন, জিল হোসেনের প্রতি অবিচার করা হয়েছে। তিনি বলেন, জিল হোসেন আমাদের ৬ ব্যাচ সিনিয়র। তিনি তখন পাস করে গেলে এখন চাকরিতে অনেক বড় পর্যায়ে থাকতেন; কিন্তু সামান্য মার্কসের জন্য তাকে ফেল করানোয় তার জীবনে নেমে এসেছিলো অন্ধকার। বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার শিক্ষকরাই সমাধান করতে পারতেন। তার প্রতি গভীর সমবেদনা; কিন্তু বিষয়টি যেহেতু বিচারাধীন, বিচার শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু তার আগেই তো তিনি চলে গেলেন ওপারে।
শুধু জিল হোসেনই নন, বিচারের নামে ভোগান্তির এমন নজির এখন ভুরি ভুরি। লাখ লাখ বিচারপ্রার্থী বছরের পর বছর এমনকি যুগ যুগ ধরে আদালতের বারান্দায় জীবন পার করে দিচ্ছেন। বিচার পাওয়ার আশায় শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করেও অনেকে মৃত্যুর আগে বিচার দেখে যেতে পারছেন না। এভাবে যুগ যুগ ধরে বিচার নিশ্চিত করতে না পেরে বিচারপ্রার্থীদের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে।
কিরণ বলেন, মামলা চালাতে গিয়ে বাবা মারা গেছেন। ২০১৮ সাল থেকে আমি মামলাটি পরিচালনা করছি। প্রতিটি রায় আমরা পক্ষে পেয়েছি কিন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ চায় মামলাটি যুগ যুগ চলুক। এ কারণে বিচার প্রলম্বিত হচ্ছে। জানি না কবে শেষ হবে। বেঁচে থাকতে চূড়ান্ত রায় আমিও দেখে যেতে পারব কিনা জানা নেই।