ননী বেওয়া। সিরাজগঞ্জ শহরের ভিক্টোরিয়া স্কুল/বিএ কলেজ রোডের বাসিন্দা। মহান মুক্তিযুদ্ধে একমাত্র বুকের ধন সন্তান হারা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদের মা তিনি। সম্ভবত দেশে তিনিই একমাত্র জীবিত কোনো শহীদের জননী। স্বাধীনতা সংগ্রামে সন্তান এবং দেশে স্বাধীনের পর স্বামী হারানো ননী বেওয়ার সংসার দুই মেয়েকে নিয়ে। সম্প্রতি তার এক মেয়ে মারা গেছেন। দেশ স্বাধীনের পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তাকে দেওয়া হয় আট শতকের এক খন্ড জমি এবং তৎসংলগ্ন ২৯ শতকের একটি পুকুর। বাড়ি এবং পুকুরটি বাৎসরিক লিজ দিয়েই মেয়ে আর নাতীদের নিয়ে কোনো রকমে চলছে তার সংসার। তবে ১৯৭৩ সাল থেকে ওই জমিতে বসবাস করলেও সরকারিভাবে স্থায়ী বন্দোবস্ত না দেওয়ায় মাঝে মধ্যেই পোহাচ্ছে নানা ঝক্কিঝামেলা।
এবার আসা যাক শহীদ আজাদ সম্পর্কে। ১৯৪৬ সালে সিরাজগঞ্জ পৌর এলাকার জানপুর মহল্লায় মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আবুল কালাম আজাদ। স্থানীয় ভিক্টোরিয়া স্কুলের ১০ শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পরেন। সেই থেকে লেখাপড়াতে তেমন আর আগাতে পারেননি। দেশ প্রেম আর মুক্তি সংগ্রামে যোগ দিতে ইচ্ছার কোনো কমতি ছিলনা আজাদের।
১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে বাড়ি থেকে বের হন আজাদ। ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ, পরে সাত নং সেক্টরের অধিনায়ক মেজর কামরুজ্জামান এবং গ্রুপ কমান্ডার খন্দকার আসাদুজ্জামানের অধীনে দেশের বিভিন্নস্থানে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন তিনি। শেষে ১৯৭১ সালের ১৭ জুলাই সন্মুখ যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে শাহাদৎ বরণ করেন তিনি।
আজাদ শহীদ হওয়ার পর – রণাঙ্গণে শহীদ হওয়ার খবরটি নিশ্চিত করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশ স্বাধীনের প্রায় ২বছর পর এক শোকবার্তায় তিনি আজাদের শহীদ হওয়ার খবর ও পরিবারকে দিতে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসকের কাছে এক হাজার টাকা পাঠান। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু স্থানীয় প্রশাসনকে শহীদ পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য একটি বাড়ি ও পুকুর দেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু সেই জমি এখন স্থায়ী বন্দোবস্ত হয়নি। যার জন্য শহীদ আজাদের মা ননী বেওয়া তার এক মেয়ে ও নাতীদের নিয়ে এখনও শঙ্কার নিয়েই বসবাস করছেন।
আজাদের মৃত্যুর পর স্থানীয় প্রশাসন – স্থানীয় জেলা প্রশাসন সরকারিভাবে লিজ দেওয়া ওই বাড়িতে ১৯৮৫-৮৬ সালে তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে দেয়। নাম দেওয়া হয় শহীদ আবুল কালাম আজাদ স্মৃতিসৌধ। যার অনেক অংশ এখন দেবে গেছে। কিছু অংশ ভেঙে গেলেও তা সংস্কার করা হয়নি।
ননি বেওয়ার অভিযোগ- শতবর্ষি শহীদ জননী ননি বেওয়া জানান, প্রতিবছর সন্তানের স্মৃতি ফলক তিনি নিজেই ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করতেন। কিন্তু এখন আর তেমন কোন কাজ করতে পারেননা। পারিবারিকভাবে এই স্মৃতিসৌধে মিলাদ আর শ্রদ্ধা জানালেও অন্য কারো দেখা পাওয়া যায় না। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের দিনে সরকার এবং জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমাকে আগে নিমন্ত্রণপত্র দেওয়া হলেও মাঝে দীর্ঘ প্রায় ১২ বছর তা বিরত রাখে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও জেলা প্রশাসন। সেই থেকে মনে হয়, একজন শহীদের মা হয়েও আমি অবজ্ঞার পাত্র। আর মুক্তিযোদ্ধারা এখন আর খোঁজও নেয়না। তবে সুখের খবর, বর্তমান জেলা প্রশাসক মুক্তিযোদ্ধা গাজী ফজলুর রহমান খানের মাধ্যমে মহান বিজয় ও স্বাধীনতা দিবসের একটি নিমন্ত্রণ পত্র পাঠিয়েছেন। তবে আমার মৃত্যুর পর মেয়ে ও নাতীদের কী অবস্থা হবে এটা ভেবেই আমার দিনরাত কাটে।
ননি বেওয়ার দাবি – ননি বেওয়া বলেন, বঙ্গবন্ধু কন্যার সময় থেকে ভাতার পাশাপাশি রেশনিং পাচ্ছেন। কিন্তু মাথাগোঁজার ঠাঁই এখনও নেই বললেই চলে। তিনি এজন্য জীবন সায়াহ্নে হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎ চান। তিনি বলেন, সিরাজগঞ্জ কলেজ মাঠে আমি শেখ সাহেবকে মাথায় টুপি পড়িয়েছিলাম। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো মা-আমিই আপনার আজাদ। এমন স্মৃতি রোমন্থন করতে তিনি কখনও চোখের জল সংবরণ করতে পেরেছেন, আবার কখনও ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি আবারও বলেন, জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগে শেখ হাসিনার সঙ্গে কথাবলাই তার শেষ ইচ্ছা। তার মতে, দেশ স্বাধীনের ৫দশক পেরিয়ে গেলেও মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেড়েই চলছে। কিন্তু দেশের জন্য যারা জীবন দিয়েছে তাদের নামের তালিকার ওপর ধুলা জমেছে, খোঁজ নিচ্ছেনা কেউ। এবিষয়ে শহীদ পরিবারের সদস্য এবং শহীদ আজাদের ভাগিনা আমিনুল ইসলাম জানান,আমার নানীর বর্তমান বয়স প্রায় ১’শ ওপরে। দেশ স্বাধীনের পর থেকে একাধিকবার চিঠি চালাচালি হলেও তাকে বসবাসের জন্য দেয়া একটুকরো বাড়ি ও পুকুরের স্থায়ি সমাধান দিতে পারেনি স্থানীয় প্রশাসন। যে কারণে বিষয়টি নিয়ে তিনি নিজেই হতাশাগ্রস্থ। আমরা পরিবারের পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি কামনা করছি বিষয়টি তার জীবন সায়াহ্নে সমাধান হোক। কারণ তার একমাত্র সন্তান মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়েছেন। বড় মেয়েকে সাথে নিয়েই ওই বাড়িতে তিনি বসবাস করছেন। আর ছেলে সন্তান না থাকাতে অনেক প্রভাবশালীর দৃষ্টি এখন ওই অসহায় মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জায়গার ওপর।
লেখক : আমিনুল ইসলাম, সাংবাদিক এবং শহীদ আজাদের ভাগ্নে